শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ১০:১৯ অপরাহ্ন
মুফতি এনায়েতুল্লাহ:
‘আমার বাবা তো কখনো আমাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসে না!’ বাবাকে অভিযোগ থেকে আড়াল করতে কিশোরের মা বললেন, ‘বাবা তো ব্যস্ত, এখানে মায়েরাই আসে।’
এবার কিশোরের অভিযোগ, ‘কেন শুধু মায়েরাই আসবে? বাবা নয় কেন? আর বাবা তো কাজে যান, আরও পড়ে!’
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোর আর তার মা কথা বলছেন। আলাপচারিতার বিষয়, কেন তার বাবা তাকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন না। মা-সন্তানের কথায় এটাও স্পষ্ট যে, বিদ্যালয়ে আসার সময়টায় তার বাবা বাসায়ই আছেন। আর এই অভিযোগ শুধু তার একার নয়, তার ক্লাসের আরও অনেকের।
বাস্তবতাও আসলে তাই। শহরের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সকাল, দুপুর কিংবা বিকেলে ছোট শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার কাজটি মায়েরাই করেন। বলা চলে, এটা তাদের নিয়মিত রুটিন। এই শিক্ষার্থীদের বাবাদের কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত। সংগত কারণেই তারা সন্তানদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে পারেন না। কিংবা তারা আসেন না। এই আসতে না পারাটা কতটুকু যৌক্তিক?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা করেন, তারা অভিভাবকদের একটি কথা বলার ও বোঝানোর চেষ্টা করেন, সন্তানকে বাবা এবং মা দুজনেরই সময় দেওয়া দরকার। কিশোর সন্তানের হাত ছোটবেলায় ধরলে, বড় হওয়ার পর সেই হাত আর ছুটে না। কিন্তু ছোটবেলায় হাত ছেড়ে দিলে, সন্তান বড় হওয়ার পর সেই হাত আর ধরা হয়ে ওঠে না।
এই হাত ধরার অর্থ কী?
কেবল বিদ্যালয়ে আনার জন্য, রাস্তায় পড়ে যাবে তা থেকে রক্ষার জন্য সন্তানের হাত ধরতে হবে, এমন নয়। তার হাত ধরতে হবে, আখলাক-চরিত্র শিক্ষার জন্য, আদব-কায়দা শিক্ষার জন্য ও মানবিকতা শিক্ষার জন্য। সন্তানকে সামাজিকতা শেখানো, বড়দের শ্রদ্ধা করতে শেখানো থেকে শুরু করে রাস্তায় হাঁটাচলা, কথাবার্তা, বন্ধুদের সঙ্গে মেশা এক কথায় সমাজে চলতে শেখানো। যদিও দুনিয়ার নিয়মে সন্তান চলাটা শেখে নেবে, সেটা বাবা-মার হাত না ধরলেও। কিন্তু সেটা পরিবার ও সমাজের জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনবে কি না, তা বলা মুশকিল। কোনো পরিবারের সন্তান নিয়ে আফসোস, অভিভাবকের হতাশা, বখে যাওয়া সন্তানের জন্য বাবা-মার বুকফাটা কান্না নতুন কিছু নয়। কথা হলো, সঙ্গদোষে সন্তান বিপথে গেল কীভাবে? সন্তান আপনার হাত থেকে ছুটল কীভাবে? বাবার স্নেহ ও শাসনভরা হাত থেকে সন্তানের হাত যেদিন ছুটে গেছে, অথবা নানা অজুহাতে আপনি ধরতে পারেননি। তখন আপনি যুবক সন্তানের হাতের নাগাল পাবেন কীভাবে? এ আশা করা নিতান্তই বোকামি। আপনি তো শুরুতেই আল্লাহর দেওয়া আমানত রক্ষা করতে পারেননি। আফসোস তো আপনাকে করতেই হবে!
সন্তানাদি দয়াময় আল্লাহতায়ালার দান ও বড় এক আমানত। আল্লাহ এর মাধ্যমে পরীক্ষা করেন বান্দা এই আমানতের যথাযথ হেফাজত করে কি না। সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা বান্দাকে দুভাবে পরীক্ষা করেন। এক. সন্তানের কারণে বান্দা আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করে কি না। দুই. বান্দা
সন্তানকে আমানত মনে করে কি না এবং সে আমানতের হেফাজতে যত্নবান হয় কি না। আল্লাহতায়ালা বলেন, জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহাপুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে।’ -সুরা আনফাল : ২৮
হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘শুনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। … পুরুষ তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। নারী তার পরিবার, সন্তান-সন্ততির বিষয়ে দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।… জেনে রাখো, প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৭১৩৮
সন্তানের পরিচর্যা প্রধানত পিতার কাজ। গঠন-নির্মাণের সূচনা যখন হয় সে বয়সে পিতার শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। সে বয়সে বহুমুখী আকর্ষণ তার গঠন ব্যাহত করতে পারে। তা থেকে সুরক্ষা দিতে হবে পিতাকে। তা দেওয়া না হলে আদরের সন্তান হাতছাড়া হয়ে যাবে। সুরক্ষার অভাবে কত পিতার বুকের ধন এক পর্যায়ে তার সুখ হরণের কারণ হয়ে গেছে। চোখ খুলে তাকালেই তা নজরে আসে। শেষ সান্ত্বনা কপালকে দুষে।
কপালের লিখন খণ্ডানো যায় না ঠিক। কিন্তু কর্মফল খণ্ডাবে কে? সাধ পূরণের চেষ্টা যদি যথাযথ না হয়, তবে অপূরণের দহন তো সইতেই হবে! যথাযথ চেষ্টার প্রধান শর্ত গোড়া থেকে চেষ্টা। যখন কাদামাটির দলা থাকে, সেই সময়কার প্রযত্ন। সেই বয়সের সুরক্ষা। তবেই মনের মতন পুতুল গড়ে উঠবে।
অনেক পিতামাতা মনে করেন, ভালো বিদ্যালয়ে ভর্তি করা বা শিক্ষকের হাতে অর্পণ করার দ্বারাই যথেষ্ট দায়িত্ব পালন হয়ে যায়। বই-খাতা কিনে দেওয়া হচ্ছে, কলম-কিতাবের কোনো অভাব রাখা হচ্ছে না, বেতনও ঠিক ঠিক পরিশোধ করা হচ্ছে, তো আর বাকি থাকল কী? বাকি তো থাকলই। তা হলো অভিভাবকের প্রযতœ। শিশু যাতে শিক্ষাকে দরকারি মনে করে, শিক্ষাকে আপন করে নিতে পারে, খেলার মতোই ভালোবাসতে পারে, ক্রমান্বয়ে সামনে অগ্রসর হতে পারে এবং ক্ষতিকর কিছুতে লিপ্ত না হয়ে পড়ে তার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া অভিভাবকেরই কাজ। সেই কাজে অভিভাবক উদাসীন হলে আফসোস তো করতেই হবে এ আর নতুন কী?
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
muftianaet@gmail.com